ক্ষুব্ধ বিএনপি নেতাকর্মিরা
টেকনাফে আরফাত রহমান কোকো ক্রীড়া সংসদের ছায়াতলে পুনর্বাসিত হচ্ছে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা
কক্সবাজারের টেকনাফে ‘আরফাত রহমান কোকো ক্রীড়া সংসদ’ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রয়েছে একাধিক চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি। সংগঠনটির নেতৃত্বের শীর্ষে রয়েছেন এমন একজন ব্যক্তি, যার বিরুদ্ধে মাদকের একাধিক মামলা রয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, বিএনপির অঙ্গসংগঠনের নামে ব্যাঙের ছাতার মতো রাতারাতি গজিয়ে উঠা এইসব সংগঠন এখন একাধিক ইয়াবা কারবারির নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। নামমাত্র ক্রীড়া চর্চার আড়ালে এখানে চলছে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি আর ইয়াবা পাচারের গোপন সিন্ডিকেট। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর তৃণমূল বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
স্থানীয় বিএনপি ও যুবদলের নেতাকর্মীরা বলছেন, খেলাধুলার নামে সংগঠন গড়ে মূলত নিজেদের ‘নেতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছেন এক শ্রেণির মাদক ব্যবসায়ী। এতে রাজনীতি ও সংগঠনের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।
জানা গেছে, ‘আরফাত রহমান কোকো ক্রীড়া সংসদ’-এর টেকনাফ উপজেলা আহ্বায়ক মোহাম্মদ ইউনুছ মাদকের মামলায় চার বছর কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন। ২০১৮ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ আটক হন তিনি। জামিনে বেরিয়ে এসে সংগঠনের ব্যানারে এলাকায় সক্রিয় হন তিনি।
পুলিশের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, ‘আরফাত রহমান খোকো ক্রীড়া সংসদ’-এর টেকনাফ উপজেলার আহ্বায়ক মোহাম্মদ ইউনুছের বিরুদ্ধে একাধিক থানায় মাদকের মামলা রয়েছে। এসব মামলার মধ্যে রয়েছে টেকনাফ, ঢাকার নিউ মার্কেট এবং চকবাজার থানায় দায়ের করা মামলা। সূত্রটি আরও জানায়, এই মামলাগুলোর অধিকাংশেই ইউনুছ মাদক বহন ও সরবরাহকারী হিসেবে অভিযুক্ত।
এর আগে হোয়াইক্যং ইউনিয়ন দক্ষিণ শাখা ‘আরফাত রহমান কোকো ক্রীড়া সংসদ’-এর যুগ্ম আহবায়ক খলিল উল্লাহ চৌধুরী চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় ইয়াবাসহ ধরা পড়ে। সে বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। এ ছাড়া কোকো ক্রীড়া সংসদের সাথে টেকনাফ সদরের ফরিদ আলম, শামসুল আলম, হ্নীলার মোহাম্মদ আলমসহ আরো অনেকে দাপটের সাথে মাঠ ময়দানে চষে বেড়াচ্ছে। ইয়াবা সিন্ডিকেট জেলা ও উপজেলা বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সাথে ছবি তুলে নিজেদের বড় বড় নেতা পরিচয়ে জাহির করে চলেছে।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, তিনি নিয়মিতভাবে সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ইয়াবার চালান গ্রহণ করেন এবং তা স্থানীয় ও আঞ্চলিক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পাচার করে থাকেন। শুধু তিনিই নন-সংগঠনটির বেশির ভাগ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধেই মাদক সংশ্লিষ্টতার একাধিক অভিযোগ রয়েছে। ফলে সংগঠনটি এখন ক্রীড়া কিংবা সামাজিক উন্নয়নের প্ল্যাটফর্ম না হয়ে, বরং মাদক কারবারিদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠছে।
গত বুধবার হ্নীলা ইউনিয়নের উত্তর শাখার ৬ নং সাংগঠনিক ওয়ার্ডের যুবদলের আহবায়ক মোহাম্মদ আকরাম ধরা পড়ে। এরপর থেকেই টেকনাফের রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়। তাদের বিরুদ্ধে দলের হাই প্রোফাইলে একাধিক অভিযোগ জমা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তবে দলের পক্ষ থেকে তাৎক্ষনিক তাকে বহিস্কার করা হয়।
একাধিক তৃণমূল বিএনপি নেতা অভিযোগ করে বলেন, “ক্রীড়া সংসদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ইয়াবার রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। এটা কোকোর নাম ভাঙিয়ে বিএনপিকে কলঙ্কিত করার শামিল।”
বিএনপির একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র জানান, টেকনাফসহ জেলার সীমান্ত অঞ্চলে রাতারাতি গজিয়ে উঠা কিছু তথাকথিত ক্রীড়া, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এখন মাদক কারবারিদের জন্য কার্যত ‘নিরাপদ পুনর্বাসন কেন্দ্রে’ পরিণত হয়েছে। ‘আরফাত রহমান কোকো ক্রীড়া সংসদ’ তার সাম্প্রতিক উদাহরণ। এ ধরনের সংগঠনের নাম ও ব্যানার ব্যবহার করে বহু চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি নিজেদের ‘সমাজসেবক’ ও ‘ক্রীড়াবিদ’ পরিচয় দিচ্ছেন। এতে শুধু সংগঠনের ভাবমূর্তিই ক্ষুণ্ণ হচ্ছে না, বরং কোটি কোটি টাকার ইয়াবা পাচারও নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারছেন তারা। এসব সংগঠন এখন হয়ে উঠেছে ইয়াবা কারবারিদের জন্য একেকটি ‘সাইবোর্ড’ বা ঢাল, যার পেছনে থেকে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে বিস্তৃত করছে তাদের অপরাধ জগত।
টেকনাফের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন, খেলাধুলা একটি ইতিবাচক ও সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যম। কিন্তু সেই খেলার নামেই যদি অপরাধীরা আশ্রয় খোঁজে, তাহলে তা শুধু একটি দলের নয়-সমগ্র সমাজের জন্যই অশনিসংকেত।
তাদের মতে, ‘কোকো’র নামে গঠিত সংগঠনটিকে বিএনপির শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নেতাকর্মীদের দায়িত্ব নিয়ে পুনর্গঠন করা উচিত। নইলে এ সংগঠন হয়ে উঠবে টেকনাফের ইয়াবা রাজনীতির ছদ্মবেশী কার্যালয়।
স্থানীয় সূত্র ও কয়েকজন তৃণমূল নেতার অভিযোগ, জেলা পর্যায়ের কয়েকজন যুবদল ও বিএনপি নেতার প্রত্যক্ষ সহায়তায় এসব ব্যক্তি সংগঠনের নেতৃত্বে আসছেন। বিনিময়ে প্রতি পদে লেনদেন হয় লাখ টাকার। গত সপ্তাহে লক্ষাধিক ইয়াবা বহনের সময় যুবদল নেতা আটকের পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ আরও ঘনীভূত হয়েছে।
স্থানীয় নেতাকর্মীরা বলেন, “আমরা যারা দল করি, জানি ইউনুছ ভাইকে। একাধিক ইয়াবা মামলার আসামি, বছরের পর বছর জেলে ছিলেন। আজ তিনি ক্রীড়া সংগঠনের নেতৃত্বে! তাহলে আমরা কি ধরে নেব, এই সংগঠনগুলো এখন ইয়াবা ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র হয়ে গেছে? এর দায় কার, কে তাকে আশ্রয় দিচ্ছে- এই প্রশ্নের উত্তর না দিলে আমরা আন্দোলনে যাব।”
টেকনাফ উপজেলা বিএনপির এক নেতা বলেন, “আগে রাজনীতি করতে ভয় ছিল পুলিশের, এখন ভয় হয় নিজের দলের ‘নেতাদের’! খেলাধুলার নামে যাদের চেনা মাদক ব্যবসায়ী, তারাই আজ সংগঠনের সভাপতি, আহ্বায়ক! যুগ্ম আহবায়ক।
সাবরাং ইউনিয়নের এক যুবদল কর্মী বলেন, “আমরা মাঠে লাঠি খাই, মামলায় পড়ি। আর কিছু ইয়াবা ব্যবসায়ী লাখ টাকা দিয়ে ‘কোকো ক্রীড়া সংসদ’ বানিয়ে নেতা হয়ে যায়- এটা কিসের রাজনীতি?”
টেকনাফ পৌরসভার সাবেক ছাত্রদলের এক নেতা বলেন, “কোকো ভাইয়ের নামে সংগঠন বানিয়ে যদি ইয়াবা বেচা চলে, তাহলে রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী? যারা এসব সুবিধা নিচ্ছে, তারা দলের শত্রু।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুবদলের সিনিয়র এক নেতা বলেন, “আমরা এসব ‘নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র’ মানি না। সংগঠনের ব্যানার ব্যবহার করে অপরাধ চাপা দেওয়া মানেই আগামী দিনে দলকে আরও কালিমালিপ্ত করা।”
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বিএনপি সমর্থক বলেন, “একটা সময় ছিল, সংগঠনের নেতারা মানুষের পাশে দাঁড়াতো। এখন তো উল্টো মানুষ ভয় পায়-কারা সংগঠনের নামে ইয়াবা বেচে, কে জানে!”
একজন উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সদস্য বলেন, “এখন রাজনীতির জায়গা দখল করে নিচ্ছে অপরাধীরা। দলের ভাবমূর্তি আজ হুমকির মুখে।”
তৃণমূলের এই ক্ষোভের মুখে এখনও টেকনাফ উপজেলা বিএনপি কিংবা জেলা বিএনপির কোনো লিখিত বা আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কেউও মুখ খোলেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ‘আরফাত রহমান কোকো ক্রীড়া সংসদ’-এর টেকনাফ উপজেলা আহ্বায়ক মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, “আমি কোনোদিন ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে ভুলক্রমে ইয়াবাসহ আটক হই এবং সেই মামলায় জেল খাটতে হয়। তাতে কি আমি ইয়াবা কারবারি হয়ে গেলাম? আমার পুরো পরিবার বিদেশে থাকে। আমি নিজেও একজন রাজনৈতিক মামলার ভিকটিম। টেকনাফে আমি সর্বপ্রথম রাজনৈতিক মামলার আসামি হয়েছিলাম। তাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাকে নিয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।”
এ ব্যাপারে ‘আরফাত রহমান কোকো ক্রীড়া সংসদ’ কক্সবাজার জেলা সভাপতি নাছির উদ্দিন বাচ্চু ও সাধারণ সম্পাদক মোরশেদ আলমের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পাঠকের মতামত